সেকালের বাঘ

সেকালে এমন সব জন্তু ছিল যা আজকাল আর দেখা যায় না—এ কথা তোমরা নিশ্চয়ই জান। সেকালের চার দাঁতওয়ালা হাতি, ত্রিশ হাত লম্বা কুমির বা হাঁসুলি-পরা তিন শিঙা গন্ডার, এর কোনটাই আজকাল পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে গুহা গহ্বরে পাহাড়ের গায়ে বা বরফের নীচে, তাদের কঙ্কালের কিছু কিছু চিহ্ন পাওয়া যায়—তা থেকেই পণ্ডিত লোকে বুঝতে পারেন যে, এক সময়ে এই-এইরকম জানোয়ার পৃথিবীতে ছিল। যাঁরা এইসকল জিনিসের চর্চা করেন, তাঁরা সামান্য একটুকরো দাঁত দেখে বলতে পারেন—এটা কি রকম জন্তুর দাঁত, সে আমিষ খায় কি নিরামিষ খাত, ইত্যাদি।

এবার যে জানোয়ারের কথা বলছি ইংরাজিতে তাকে বলে Sabre-toothed Tiger (অর্থাৎ খড়্গদন্ত বাঘ)। এর কঙ্কাল ইউরোপে, আমেরিকায়, আমাদের দেশে এবং আরও নানা জায়গায় পাওয়া গিয়াছে। এই খড়্গের মতো দাঁত দুটিতে তার কি কাজ হত, সে কথা বলা বড় শক্ত। অত লম্বা দাঁত দিয়ে কামড়াবার সুবিধা হয় না; তাছাড়া, এই বাঘের চোয়ালের হাড় আজকালকার বাঘের মতো মজবুত নয়, সুতরাং তার কামড়ের জোরও কম ছিল। দাঁত দুটি প্রায় ছয় ইঞ্চি করে লম্বা, তার গায়ে ছুরির মতো ধার—হয়ত তা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শিকারের মাংস ছাড়াবার সুবিধা হত। যে জন্তু যে-রকম স্থানে যে-রকম অবস্থায় বাস করে সে অনুসারে তার চেহারা ও গায়ের রং কিছু না কিছু বদলিয়ে আসে। বাঘের গায়ে যে কালো কালো দাগ দেখতে পাও তাতেই বুঝতে পারা যায় যে, ঝোপ জঙ্গলে চলাফিরা তার অভ্যাস আছে—সেখানে বড় বড় ঘাসের ঝোপে যখন বাঘমশাই লুকিয়ে থাকেন তখন সেই খাড়া ঘাসের আলো-ছায়ার সঙ্গে বাঘের হলদে-কালোর ডোরাগুলি এমনিভাবে মিশিয়ে যায় যে হঠাৎ দেখলে বুঝবার যো নেই যে ওখানে ঝোপ ছাড়া আর কিছু আছে। কিন্তু যতদূর বোঝা যায়, তাতে মনে হয় আমাদের খড়্গদন্ত মহাশয় সিনহের মতো খোলা জায়গাতেই সাধারণত বাস করতেন—সুতরাং তাঁর গায়ে একালের বাঘের মতো দাগ না থাকাই সম্ভব বোধ হয়।

একালের বাঘের চাইতে খড়্গদন্তের মুখখানা অনেকটা লম্বাটে গোছের ছিল। তার লেজটিও সাধারণত একটু বেঁটে হত। শরীরের গড়নটা মোটের উপর আজকালকার বাঘেরই মতো, কিন্তু একটু ভারি গোছের—বিশেষত সামনের পায়ের দিকটা। সুতরাং তার পক্ষে খুব দৌড়ান বা লাগান বা চট্‌পট্‌ হাত পা নাড়া বড় সহজ ছিল না। নানান যুগের নানারকম পাথরে এই বাঘের কঙ্কাল পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় যে, এরা বহুকাল ধরে পৃথিবীতে নানা দেশে দৌরাত্ম্য করে তারপর কেন জানি না একেবারে লোপ পেয়েছে।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে