তিমির খেয়াল

রুশিয়ার দুরন্ত শীতে মানুষ যখন নির্জন পথে চলাফেরা করে তখন অনেক সময় নেকড়ে বাধের পাল তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে চলিতে থাকে। তাহারা যে বন্ধুভাবে চলে না, তা অবশ্য বুঝিতেই পার। তাহাদের দূরে রাখিবার জন্য মানুষে অস্ত্রশস্ত্র বন্দুক লইয়া পথে বাহির হয় এবং পারতপক্ষে একলা কেহ সে সকল পথে যাওয়া আসা করিতে চায় না।

সমুদ্রের পথে যখন বড় বড় জাহাজ চলাফিরা করে তখনও অনেক সময় দেখা যায়, তাহাদের আশেপাশে নানা জাতীয় মাছ ও হাঙর ঘুরিয়া বেড়ায়। জাহাজ হইতে কত জিনিস কত সময়ে জলে ফেলা হয়, তাহার মধে তরকারির খোসা, মাংসের বা হাড়ের টুকরা, নষ্ট খাবার প্রভৃতি কিছু জলে পড়িবামাত্র তাহারা কাড়াকাড়ি করিয়া সব খাইয়া ফেলে। ঐ খাবারের লোভেই তাহারা জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে চলে। কেবল মাছ কেন, কত পাখিকেও অনেক সময়ে দেখা যায় মাঝসমুদ্রে জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে শত শত মাইল উড়িয়া চলিতেছে। তাহাদের অনেকে আসে কেবল কৌতূহল মিটাইবার জন্য, অনেকে আসে খাইবার লোভে অথবা বিশ্রামের আশায়। কিন্তু খামখা বিনা কারণে কেহ জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে চলে না।

কিন্তু নিউজিল্যান্ডের উপকূলের কাছে এক জায়গায় ছোটখাট— অর্থাৎ মোটে বারো হাত লম্বা একটি তিমি আছে, তাহার বাড়ির কাছ দিয়া যত জাহাজ চলাফিরা করে সকলের সঙ্গেই সে আত্মীয়তা করিতে আসে। এইরকম সে কত বছর করিয়া আসিতেছে, কেন করে তাহা কেহ জানে না। জাহাজ হইতে যে-সকল খাবার জিনিস জলে ফেলা হয় তাহার কোনটাই তাহার খাদ্য নয়— জাহাজের লোকদের দ্বারা তাহার কোনরকম উপকার হওয়াও সম্ভব নয়— অথচ সে প্রত্যেক জাহাজের সঙ্গে একবার খানিক দেখা না করিয়া ছাড়ে না। শুধু দেখা নয়, আধ ঘণ্টাখানেক অনায়াসে জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে যে এমনভাবে চলে যেন সে জাহাজটাকে পথ দেখাইয়া লইতে চায়। মাঝে মাঝে জাহাজের গায়ে গা ঘেষিয়া আর ঢেউয়ের ফেনায় ডিগবাজি খাইয়া সে নানারকমে মনের আহ্লাদ প্রকাশ করে।

সেখানকার নাবিকেরা সকলেই এই অদ্ভুত তিমির কথা জানে। তাহারা আদর করিয়া তাহার নাম দিয়াছে 'পেলোরাস্‌ জ্যাক্‌'— 'পেলোরাস্‌' ওই জায়গাটার নাম। এই তিমির সম্বন্ধে সে দেশে অনেকরকম অদ্ভুত গল্প শোনা যায়। একবার নাকি কোন্‌ জাহাজ হইতে কে একজন লোক 'জ্যাক'কে গুলি করিয়াছিল— তারপর অনেকদিন তাহাকে দেখা যায় নাই। আবার সে ফিরিয়া আসিল বটে, কিন্তু সেই জাহাজটার কাছে আর কখনও আসে নাই। নিউজিল্যান্ড মাওরিদের দেশ— তাহারা এই তিমিকে দেবতার মতো ভক্তি করে। এমনকি সে দেশের গভর্নমেন্ট পর্যন্ত ইস্তাহার দিয়া সকলকে অনুরোধ করিয়াছেন যে, কেন যেন 'জ্যাকে'র কোনরকম অনিষ্ট না করে।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে