সমুদ্রের ঘোড়া

সমুদ্রের ঘোড়া বলতে হঠাৎ যেন সিন্ধুঘোটক মনে করে বসো না। সিন্ধুঘোটক থাকে সমুদ্রের ধারে, কিন্তু তাকে ঘোটক বলা হয় কেন তা জানি না। তার চালচলন চেহারা বা শরীরের গড়ন কিছুই ঘোড়ার মতো নয়— ঘোড়ার সঙ্গে তার খুব দূর সম্পর্কেও কোন সম্বন্ধ পাওয়া যায় না— অথচ তাকে বলি 'সিন্ধুঘোটক'। হিপ্পোপটেমাসকে বাংলায় অনেক সময় 'জলহস্তী' লেখা হয়। তারও কিন্তু প্রকাণ্ড নাদুসনুদুস চেহারাটি ছাড়া হাতির সঙ্গে আর কোনরকম মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং তাকে শুয়োরের সঙ্গে সমতুলনা করলে তার পরিচয়টা অনেকটা ঠিক হয়।

এখানে যাকে সমুদ্রের ঘোড়া বলছি, তাকে বর্মধারী মাছ বললেই তার ঠিক মত পরিচয় দেওয়া হয়। কিন্তু তার ঐ অদ্ভুত ঘাড় বাঁকান চেহারা আর খাড়া হয়ে চলাফিরা— এই দেখেই ইংরেজিতে তার নাম দেওয়া হয়েছে সমুদ্রের ঘোড়া (Sea Horse)। চেহারার বর্ণনা হিসাবে নামট যে চমৎকার হয়েছে, তাতে আর সন্দেহ নেই। এই জন্তুর ল্যাজের দিকটা একেবারের মাছের মতো নয়— তার উপর গায়ের চামড়াটিও চিংড়িমাছের খোলার মতো শক্ত। ল্যাজটি থাকাতে তার ভারি সুবিধা। যখন ইচ্ছা জলের নীচে শেওলা গাছে ল্যাজটি জড়িয়ে সে বেশ আরাম করে বিশ্রাম করে। যখন জলের নীচে মাথা উঁচিয়ে ল্যাজ নাড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে এরা চলে ফিরে, তখন তেজী ঘোড়ার টগ্‌বগ্‌ করে ছুটবার ধরনটাও মনে পড়ে। আসলে এরা যে 'নল' মাছের জাতভাই, সেটা এদের চোঙের মতো মুখ দেখলেই বোঝা যায়। নলমাছের চেহারাটা ঠিক তার নামেরই মতো। নলমাছের মুখখানা এমনভাবে তৈরি যে সে হাঁ করতে পারে না। ঐ চোঙার আগায় একটু ফুটো আছে, তাই দিয়ে সে সুড়সুড় করে খাবার টেনে খায়। সমুদ্রের ঘোড়ার মুখখানিও ঠিক এই ধরনের।

এই অদ্ভুত জন্তুগুলির এক একটা আবার ত্রিভঙ্গ ঘোড়ার মতো চেহারা করেও সন্তুষ্ট নয়। তারা নানারকম সাজ করে রংবেরঙের ঝালর ঝুলিয়ে কেমন কিম্ভুত কিমাকার মূর্তি করে থাকে। ঝালরের সাজগুলো বাস্তবিক তার গায়ের চামড়া। ইংরাজিতে এদের বলে সমুদ্রের 'ড্র্যাগন' (Sea Dragon) বা রাক্ষস। নামটি ভয়ংকর হলেও জন্তুটি ঠিক সমুদ্রের ঘোড়ার মতোই নিরীহ। তার ঐ রংচঙে পোশাকের বাহারটা কেবল শত্রুর চোখে ধোঁকা দেবার জন্য। সমুদ্রের নীচে যেসব অদ্ভুত রঙিন বাগান থাকে, তারই মধ্যে ফুল পাতার সঙ্গে রং মিশিয়ে এরা বেমালুম গা ঢাকা দিয়ে থাকে। নানারকম হিংস্র জন্তু আর মাছ সেখানে ঘোরে ফিরে। তারা এর চেহারা দেখে হঠাৎ বুঝতেই পারে না যে এটাও একটা জানোয়ার।

এদের আর একটি বড় মজার অভ্যাস আছে— এরা সব সময় ছানার দল সঙ্গে নিয়ে ফেরে। ক্যাঙারুর পেটে যেমন থলি থাকে, তার মধ্যে ছোট ছোট ছানাগুলো দরকার হলেই ঢুকে পড়ে— তেমনি ওদেরও কারও বুকে, কারও পেটে ছোট ছোট থলির মতো থাকে। ছানারা ভয় পেলে ছুটে তার মধ্যে লুকোয়।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে