শামুক ঝিনুক

আমাদের শরীরের ভিতরকার শক্ত কাঠামোটিকে আমরা কঙ্কাল বলি। কঙ্কালটা ভিতরে থাকে আর এই রক্ত মাংসের শরীর তাহাকে ঢাকিয়া রাখে— এইরূপই আমরা সচরাচর দেখি। কিন্তু এমন জীবও আছে যাহার কঙ্কালটা থাকে শরীরের বাহিরে। এমন অদ্ভুত কাণ্ড কেহ দেখিয়াছ কি? বোধহয় সকলেই দেখিয়াছ; কারণ, আমি কন অসাধারণ বিদ্‌ঘুটে জন্তুর কথা বলিতেছি না— এই নিতান্ত সাধারণ শামুক ঝিনুক প্রভৃতির কথাই বলিতেছি।

শামুক ঝিনুকের মতো নিতান্ত সামান্য জিনিসের মধ্যে যে কত আশ্চর্য ব্যাপার লুকান থাকে, ভাবিলে অবাক হইতে হয়। তোমরা গেঁড়ি দেখিয়াছ? বাগানে পুকুরের কাছে স্যাঁৎসেঁতে জায়গায় ছোট ছোট জীবন্ত শামুকগুলি যারপরনাই অলসভাবে আস্তে আস্তে চলাফিরা করে— তাহাদের নাম গেঁড়ি। ঝিনুকের মধ্যে যে জীবন্ত প্রাণীটি বাস করে, তাহার চালচলনটিও কম অদ্ভুত নয়। তাহাদের অনেকেই সারা জন্ম মাটি আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকে। কেহ কেহ এমন গোঁয়ার, তাহারা ক্রমাগত পাথর ফুঁড়িয়া তাহার ভিতর ঢুকিতে চায়। দুই-একজন আছে তাহারা লাফান বিদ্যাটি বেশ অভ্যাস করিয়াছে, কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ তড়াক করিয়া এক একটা লাফ দেয়। আর সমুদ্রের নীচে শুক্তিগুলো যে আপনাদের খোলার ভিতরে ছোট বড় নানারকম মুক্তা জমাইয়া রাখে, তাহার কথাও তোমরা নিশ্চয়ই জান। একরকম পোকার জ্বালায় অস্থির হইয়া ঝিনুকের গায়ে রস গড়ায় আর সেই রস জমিয়া মুক্তা হয়।

শামুক বা ঝিনুকের যখন জন্ম হয় তখন তাহাদের খোলাটি থাকে না, তাহার জায়গায় একটা পুরু চামড়ার মতো থাকে; সেই চামড়াটি শক্ত হইয়া ক্রমে মজবুত খোলা তৈরি হয়। যে ডিম ফুটিয়া ছানা বাহির হয়, সেই ডিমগুলি দেখিতে বড়ই অদ্ভুত। কতগুলি ছোট ছোট পোঁটলা একসঙ্গে মালার মতো বাঁধা থাকে। প্রত্যেকটি পোঁটলার মধ্যে কতগুলি ডিম। এক একটি শামুক অনেকগুলি ডিম পাড়ে— একশ দেড়শ হইতে দশ বিশ হাজার। কিন্তু এ-বিষয়ে এক একটা ঝিনুকের ওস্তাদি অনেক বেশি। সমুদ্র বা নদীর জলে এমন সব ঝিনুক দেখা যায় যাহারা একেবারে দশ বিশ লাখ ডিম পাড়ে। ডিম ফুটিয়া যখন ছানা বাহির হয়, তখন তাহাদের খাইবার জন্য নানারকম জীবজন্তু চারিদিক হইতে ঘিরিয়া আসে, কারণ খোলা জমিবার আগে এই নরম অবস্থাতেই এগুলিকে খাইবার সুবিধা। বাস্তবিক, অল্প বয়সেই ইহারা যদি এরূপভাবে উজাড় না হইত, তবে শামুক ঝিনুকের অত্যাচারে পৃথিবীতে বাস করাই দায় হইত। যে প্রাণী এক একবারে হাজার হাজার জন্মিতেছে তাহাদের প্রত্যেকটি যদি বড় হইতে পায়, আর প্রত্যেকের হাজার হাজার করিয়া ছানা হয়, আর এইরকম বছরের পর বছর চলিতে থাকে, তবে অবস্থাটা নিতান্তই সাংঘাতিক হইয়া দাঁড়ায় বৈকি। এরূপভাবে বাড়িতে পারিলে একটিমাত্র শামুকের বংশধরেরা পাঁচ সাত বৎসরের মধ্যে কলিকাতা সহরটিকে একেবারে বেমালুম ঢাকিয়া দিতে পারিত।

বলিতে গেলে এক সময় এই পৃথিবীতে ইহাদেরই রাজত্ব ছিল। সেকালের হিসাবেও ইহা খুবই পুরাতন সময়ের কথা। তখন আর কোন জীবজন্তু ছিল না, কেবল নানারকম শঙ্খ আর অদ্ভুত জলজন্তুরা এই দুনিয়ার পরিচয় লইয়া ফিরিত। আজও তাহাদের কঙ্কাল জমিয়া কত মাটির নীচে কত সমুদ্রের বুকে বড় বড় স্তর বাঁধিয়া আছে।

গেঁড়ির কথা বলিতে গেলে সব চাইতে বড় যে আফ্রিকার রাক্ষুসে গেঁড়ি তাহার কথাও বলা উচিত। সেগুলি কতখানি বড় তাহা পুরাপুরি দেখাইতে গেলে সন্দেশের পৃষ্ঠায় কুলাইবে না। ইহারা একটি করিয়া লম্বা গোছের ডিম পাড়ে— ঠিক পাখির ডিমের মতো শক্ত আর সাদা।

কিন্তু সমুদ্রের শঙ্খজাতীয় জন্তুদের মধ্যে ইহার চাইতে অনেক বড় জীবও বিস্তর দেখা যায়। তাহাদের এক একটির খোলা এমন প্রকাণ্ড হয় যে, একটি ছোটখাট ছেলেকে তাহার মধ্যে অনায়াসে শোয়াইয়া রাখা যায়।

শামুকেরা খায় কি? নরম ঘাস, কচি পাতা, জলের পানা— এইগুলি অনেকেরই প্রধান খাদ্য। আবার কেহ কেহ আছেন, তাঁহাদের নিরামিষে রুচি নাই, তাঁহারা নানারকম পোকামাকড়, জলেই কীট এই সকল খাইয়া থাকেন। ঝিনুকেরও খাওয়া এইরকমই, তবে তাহারা এক জায়গায় পড়িয়া থাকে বলিয়া তাহাদের আহার জুটিবার সুযোগ কিছু কম। ঝিনুকের খোলার দুটি করিয়া পাট থাকে, সে দুটিকে তাহারা ইচ্ছামত কব্‌জা ঘুরাইয়া খুলিতে ও জুড়িয় দিতে পারে। খাবারের দরকার হইলে তাহারা সেই দরজা ফাঁক করিয়া রাখে; চলিতে চলিতে অথবা স্রোতে ভাসিয়া যেসকল কীত সেই হাঁ-করা মুখের মধ্যে আসিয়া পড়ে তাহাদের সে চট্‌পট্‌ খাইয়া ফেলে। শামুক আর ঝিনুকের খাওয়ার মধ্যে আর একটি তফাৎ এই যে, ঝিনুকের দাঁত নাই কিন্তু শামুকের দাঁত আছে। দাঁত বলিতে মানুষের দাঁতের মতো কিছু একটা মনে করিও না। এই দাঁতগুলি তাহাদের জিভের গায়ে অতি সূক্ষ্মভাবে সাজান থাকে; এক একটা শামুকের প্রায় দুই চারশ বা হাজার দেড় হাজার দাঁত! উখার মতো ধারাল এই জিভটিকে সে তাহার খাবারের ভিতরে, উপরে , আশেপাশে ঘ্যাঁশ্‌ ঘ্যাঁশ্‌ করিয়া চালাইতে থাকে। তাহাতেই খাবার জিনিস সব টুকরা টুকরা হইয়া থ্যাঁৎলাইয়া কাদার মতো নরম হাইয়া যায়। এক একটার জিভের আগা পর্যন্ত সাংঘাতিক ধারাল; সেই জিভ দিয়া তাহারা অন্য জন্তুর গায়ে ফুটা করিয়া দেয়, নিরীহ ঝিনুকগুলির খোলা ফুটা করিয়া তাহাদের চুষিয়া খায়।

তারপর শামুক ঝিনুকের চেহারার বাহার যদি বর্ণনা করিতে বসি, তবে ত শেষ করাই মুশকিল হইবে। কত হাজাররকমের শঙ্খ, তাহার কতরকম আকার, কত রকম রং। তার এক একটার যে কি আশ্চর্য সুন্দর গড়ন শুধু কথায় তাহা আর কত বোঝান যায়।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে