নাকের বাহার

মানুষের নাকের প্রশংসা করতে হলে তিল ফুলের সঙ্গে, টিয়া পাখির ঠোঁটের সঙ্গে গরুড়ের নাকের সঙ্গে তার তুলনা করে। কেউ কেউ আবার বলেন শুনেছি 'বাঁশির মতো নাক'। কিন্তু মোটের উপর এ কথা বলা যায় যে, সকলের নাকেরই মোটামুটি ছাঁদটি সে একঘেয়েরকমের; দো-নলা সুরঙ্গের মতো। কারো নলদুটি সরু, কারো বা মোটা, কারো চ্যাপটা, কারো উঁচু—কারো মাঝখানে ঢালু, কারো আগাগোড়াই ঢিপি—এইরকম সামান্য উনিশ-বিশ যা একটু তফাৎ হয়। কারো কারো নাক যদি হাতির শুঁড়ের মতো লম্বা হত কি গণ্ডারের মতো খড়্গধারী হত, অথবা আর কোন উদ্ভট জানোয়ারের মতো হত, তাহলে বেশ একটু রকমারি হতে পারত।

হাতির শুঁড়টাই যে তার নাক এ কথা তোমরা নিশ্চয়ই জান। হাতির পরেই যে জন্তুটির নাম করা যায়, তার নাম টেপির; এর নাকটিও শুঁড় হতে চেয়েছিল, কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেনি। তার পরেই মনে পড়ে পিঁপড়ে-খোরের কথা, এরও একটা শুঁড় আছে কিন্তু সেটা শুধু নাক নয়, নাকমুখ দুই মিলে লম্বা হয়ে ওরকম হয়ে গেছে। কুমিরেরও ঠিক তাই। আর একটি আছে চোঙামুখ, তার পরিচয়ও তোমরা সন্দেশে পেয়েছ ('সমুদ্রের ঘোড়া')। তারপর দুরকমের ছুঁচো আছে, তার একটির বেশ স্পষ্টরকম শুঁড় গজিয়েছে, আর একটি কেবল শুঁড়ে সন্তুষ্ট নয়, তার নাকের আগাটি হয়েছে ঠিক ফুলের মতো। এই সৌখিন ছুঁচোটির গায়ের গন্ধ কিন্তু ফুলের মতো একেবারেই নয়। তার চেয়ে জমকালো নাকের কথা যদি বলতে হয় তবে পুষ্পনাসা বাদুরের কথাটা নিতান্তই বলা উচিত। পর্দার পর পর্দা গোলাপফুলের পাপড়ির মতো সাজিয়ে তার উপরে যেন তিলক চন্দন এঁকে নাকটিকে তৈরি করা হয়েছে। এত ঘটা করে নাকের বাহার ফোটাবার উদ্দেশ্যটা কি, মুখের 'সৌন্দর্য' বাড়ান না শত্রুকে ভয় দেখান, তা আমি জানি না।

পুষ্পনাসার পরে আসে হংসচঞ্চু, তার নাকমুখ হাঁসের ঠোঁটের মতো চ্যাপটা। আর রয়েছে ম্যান্‌ড্রিল বাঁদর। এর রংটাই হচ্ছে এর আসল বাহার। টুক্‌টুকে লাল নাক, তার দু-পাশে নীলরঙের ঢিব্‌লি, তার উপর চমৎকার কারুকার্য—যারা কলকাতায় আছ তারা চিড়িয়াখানায় গেলেই একবার স্বচক্ষে দেখে আসতে পার। ম্যান্‌ড্রিলের সঙ্গে মনে পড়ে নাকেশ্বর বানর। এর নাক সম্বন্ধে আর বেশি কথা বলবার দরকার নেই, ছোটখাট বেগুনের মতো নাকটি। বাঁদরের খাঁদা নাকের দুর্নাম সকলেই করে, কিন্তু এই নাকটি খাঁদা না হলেও তাতে তার সুনাম বাড়বে কিনা সন্দেহ।

ব্যাং যখন হাতির উপর রাগ করে বলেছিল "বড় যে ডিঙোলি মোরে"—তখন হাতি তাকে "থ্যাব্‌ড়ানাকী" বলে গাল দিয়েছিল। হাতির গালটা খুব লাগসই হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যাঙের বংশেও যে সকলেরই থ্যাব্‌ড়া নাক, তা নয়। এমন ব্যাংও আছে যাদের নাকটি চড়াই পাখির ঠোঁটের মতো দিব্যি চোখাল।

কোন কোন জন্তু আবার শুধু নাকটাকে নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তারা নাকের সঙ্গে আস্ত্রশস্ত্র জুড়ে বেড়ায়। গণ্ডারের খড়্গটি থাকে তার নাকে উপরে। আফ্রিকায় একরকম বরাহ আছে তার নাম বাবিরুসা, তার নাকের দুপাশে চামড়া ফুঁড়ে দুই জোড়া দাঁত শিঙের মতো উঁচু হয়ে থাকে। তলোয়ার মাছের নাকের ডগায় যে অস্ত্রটি বসান থাকে তাতে বাস্তবিকই তলোয়ারের কাজ হয়। করাতি মাছের তলোয়ারটির গায়ে আবার করাতের মতো দাঁত কাটা থাকে। বঁড়শিবাজ মাছের কথা শুনেছ—তারা নাকের আগায় বাঁকা ছিপের মতো লম্বা নোলক ঝুলিয়ে রাখে। উদ্দেশ্য, অন্য মাছকে ভুলিয়ে এনে তার ঘাড় ভেঙে খাওয়া। কোন কোন জন্তুর নাকটা যে কোথায় সেটা হঠাৎ খুঁজে পাওয়াই শক্ত। তিমি মাছের মাথার উপর যেখানে তার চোখ থাকবার সম্ভাবনা মনে হয় সেখানে তার নাক থাকে। কাঁটাল গিরগিটির গা-ভরা উবড়ো খাবড়ো শিঙের মতো কাঁটার ঝোপ—তার মধ্যে তার নাক মুখ চোখ অনেক সময়েই বেমালুম লুকিয়ে থাকে। আর হাতুড়িমুখো হাঙরের চেহারা ত আগাগোড়াই উলটারকম। একটা দুমুখো হাতুড়ির মতো তার মাথা, সেই হাতুড়ির দুই মাথায় দুটি চোখ। আর নাকটা হচ্ছে হাতুড়ির মাঝামাঝি—হাতুড়ির ডাণ্ডাটা যেখানে বসান থাকে সেইখানে।

এখন তোমরা বল, এর মধ্যে কার নাকের বাহার বেশি।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে