ধূলার কথা

ঘরের দেয়াল মেঝে আসবাবপত্র যতই ঝাড়ি যতই মুছি, খানিকক্ষণ রাখিয়া দিলেই আবার দেখি, যেই ধূলা সেই ধূলা। এত ধূলা আসেই বা কোথা হইতে, আর এ ধূলার অর্থই বা কি?

টেবিলের উপর হইতে খানিকটা ধূলা সংগ্রহ করিয়া অণুবীক্ষণ দিয়া দেখ—তাহার মধ্যে চুন, সুরকি, কয়লার গুঁড়া হইতে আঁশ, পোকার ডিম, ফুলের রেণু পর্যন্ত সবই পাওয়া যাইতে পারে। আরও সূক্ষ্মভাবে দেখিতে পারিলে কত সাংঘাতিক রোগের বীজও তাহার মধ্যে দেখা যাইবে। জানালার ফাঁক দিয়া যে আলোর রেখা ঘরের মধ্যে আসে তাহার মধ্যেও চাহিয়া দেখ, ধূলা যেন কিল্‌বিল্‌ করিতেছে। এই ধূলার মধ্যেই আমরা বাস করি চলি ফিরি, নিশ্বাস লই। মানুষ যত দূর দেখিয়াছে, যত দূর খুঁজিয়াছে, ধূলার আর শেষ কোথাও নাই। আকাশে খুঁজিয়া দেখ; যত দূর উঠিবে, তত দূর ধূলা—যেখানে মেঘ নাই কুয়াশা নাই, বাতাস যেখানে অসম্ভবরকম পাতলা সেখানেও ধূলার অভাব নাই। সে ধূলা যে কত সূক্ষ্ম তাহা চোখে মালুম হয় না, অণুবীক্ষনের হিসাব দিয়া বুঝিতে হয়। অথচ সে ধূলাও বড় সামান্য নয়— সেই ধূলাই সারাটি আকাশকে নীল রঙে রাঙাইয়া রাখে, সেই ধূলাই উদইয়াস্তের সময় সূর্যকিরণকে শুষিয়া এমন আশ্চর্য জমকালো রঙের সৃষ্টি করে। আরও দূরে যাও, পৃথিবী ছাড়িয়া যেখানে আকাশের খোলা ময়দান পড়িয়া আছে সেখানে যাও; দেখিবে, যে নিয়মে গ্রহ চন্দ্র সকলে আপন আপন পথে ঘুরিতেছে সেই একই নিয়মে অতি ক্ষুদ্র ধূলিকণাও আকাশপথে বড় বড় চক্র আঁকিয়া চলিতেছে। এই প্রকাণ্ড পৃথিবী যদি একটি ধূলিকণার মতোই হইত, তবুও সে এমনিভাবে বছরের পর বছর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিত—কে তখন তাহার খবর রাখিত?

এই পৃথিবীর উপর ধূলার যে অদ্ভুত খেলা চলিয়াছে তাহাকে ধূলার খেলা বলিয়া জানে কয়জন? যখন কণায় কণায় বৃষ্টিজল জমিয়া বর্ষাধারা নামিতে থাকে, যখন কুয়াশার ঘনঘটায় চারিদিক ঢাকিয়া ফেলে তখন নিশ্চয় জানিও এ সমস্তই ধূলার কৃপায়। ধূলা না থাকিলে বাষ্পকণা জমিয়া জল হয় না, স্বচ্ছ আকাশে মেঘ কুয়াশার জন্ম হয় না।

সুতরাং ধূলা জিনিসটাকে আমরা যতই আমাদের জিনিস বলিয়া উড়াইয়া দেই না কেন, উৎপাত মনে করিয়া তাহাকে যতই দূর করিতে চাই না কেন, আর তাহার পরিচয় লওয়াটা যতই অনাবশ্যক ভাবি না কেন, আসলে সে বড় সামান্য জিনিস নয়। তোমরা হয়ত বলিবে, 'সামান্য না হউক, জিনিসটা বড় বিশ্রী ও নোংরা।' হাঁ, নোংরা বটে। যখন সে আমার সাফ কাপড় ময়লা করিয়া দেয়, আবার ঘরের মধ্যে যেখানে সেখানে জমিয়া থাকে, যেখানে তাহাকে দিয়া আমার কোন দরকার নাই সেইখানে আসিয়া পড়ে—তখন তাহাকে নোংরা বলি। কিন্তু 'ধূলা' বলিলেই যে একটা নোংরা বিশ্রী কিছু ভাবিতে হইবে, এরূপ মনে করা ঠিক নয়। প্রজাপতির পালক ঝাড়িলে যে ধূলা পড়ে তাহা চোখে দেখিতে অতি সূক্ষ্ম একটুখানি হালকা গুঁড়ার মতো দেখায়—দেখিলে কেহই তাহাকে ধূলা ছাড়া আর কিছুই বলিবে না। কিন্তু অণুবীক্ষণ দিয়া তাহাকে এমনই সুন্দর দেখায়। বাতাসে যে সকল ধূলিকণা ভাসিয়া বেড়ায় তাহার মধ্যেও কত সময়ে কত আশ্চর্যরকমের কারিকুরি দেখা যায়।

গভীর সমুদ্রের তলা হইতে পাঁক ঘাঁটিয়া বা পচা পুকুরের উপরকার ময়লা ছাঁকিয়া যে জীবন্ত ধূলি বাহির হয় তাহার মতো সুন্দর জিনিস খুব অল্পই আছে। এগুলিকে উদ্ভিদ বলিতে পার, কিন্তু উদ্ভিদ বলিতে সাধারণত যেরকম জিনিস মনে করিয়া বসি, এগুলি একেবারেই সেরূপ নয়। ইংরাজিতে ইহাদিগকে ডায়াটম্‌ (Diatom) বলে—আমরা এখানে তাহাকেই জীবন্ত ধূলি বলিতেছি। এই 'Diatom' কথাটি, ইহার o অক্ষরটির মধ্যে যেটুকু ধরে তাহার চাইতেও কম পরিমাণ ধূলিকে অণুবীক্ষণের সাহায্যে ফটো তুলিয়া দেখিতে পার। জলের উপর শেওলার মতো এই অদ্ভুত জিনিসগুলি কত সময়ে ভাসিতে থাকে। সাধারণ লোকে তাহাকে নোংরা ও বিশ্রী বলিয়া এড়াইয়া চলে, তাহার ভিতরে যে কি আশ্চর্য সূক্ষ্ম কাজ তাহারা সে সংবাদ রাখে না। কিন্তু যাঁহারা এ সকলের চর্চা করেন তাঁহারা এই ময়লা ঘাঁটিয়া এইসব উদ্ভিদ সংগ্রহ করেন ও তাহাদের চালচলন আকার-প্রকার লক্ষ করিয়া তাহাদের জীবন সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা আমাদের শুনাইয়া থাকেন। ডায়াটম্‌গুলিকে পোড়াইয়া সাফ করিলেও তাহার জীবকঙ্কাল সহজে নষ্ট হয় না—এগুলি এমনই মজবুত! ইহাদের আসল বাহার এই কঙ্কালগুলিতেই। জীবন্ত অবস্থায় এই কঙ্কালগুলি সবুজ কোষের মধ্যে ঢাকা থাকে। ইহাদের কারিকুরিগুলা তখন অণুবীক্ষণ দিয়াও চোখে পড়ে না।

এ পর্যন্ত অন্তত দশ হাজাররকমের ডায়াটম্‌ পাওয়া গিয়াছে। ছবিকে যত বড় করিবে তাহার গায়ে কারিকুরির মধ্যে ততই আরো আশ্চর্য সূক্ষ্ম কাজ দেখা যাইবে।

জীবন্ত অবস্থায় এই ডায়াটম্‌গুলির মধ্যে আরেকটি অদ্ভুত ব্যবস্থা দেখা যায় এই যে হাত পা কিছুই নাই অথচ তাহারা চলিয়া বেড়ায়। জলের মধ্যে এমন সুন্দর সহজভাবে তাহারা ঘুরিয়া চলে যে দেখিলে আশ্চর্য লাগে। কি করিয়া যে তাহারা চলে, তাহার কারণ ঠিক করিতে গিয়া বড় বড় পণ্ডিতদের অবধি মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে।

এ পর্যন্ত অন্তত দশ হাজাররকমের ডায়াটম্‌ পাওয়া গিয়াছে। অণুবীক্ষণে যত বড় করিয়া তাদের দেখানো হইবে, তাহার গায়ের কারিকুরির মধ্যে ততই আরো আশ্চর্য সূক্ষ্ম কাজ দেখা যাইবে।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে