আষাঢ়ে জ্যোতিষ

মানুষের বিদ্যায় যেখানে কুলায় না কল্পনা সেখানের অভাব পুরাইয়া লয়। প্রাচীন কালের মানুষ যাহারা চন্দ্র সূর্য মেঘ বৃষ্টি আগুন বিদ্যুৎ দেখিয়া অবাক হইত অথচ কোন ঘটনার কারণ খুঁজিয়া পাইত না, কোন কিছুর মর্ম বুঝিত না, তাহারাও এইসব ব্যাপার সম্বন্ধে নানারকম কল্পনা কারিতে ছাড়ে নাই। সেইসব প্রাচীন কালের কল্পনা কিন্তু কত দেশের কত পুরাণে কত গল্পের আকারে এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কেমন করিয়া সৃষ্টি হইল, তাহার কতরকম কাহিনী লোকের মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে, আজও তাহা শুনিলে আমাদের কৌতূহল জাগে। নানান দেশের নানান কাহিনীর মধ্যে সত্য ঘটনা আর কল্পিত কাহিনী এমনভাবে জড়ানো আছে যে, তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তাহা ঠিক করাই কঠিন।

এই পৃথিবীর সম্বন্ধেই কত গল্প মানুষে বানাইয়াছে। আমাদের দেশেই এক-এক পুরাণে তার এক একরকম ঘটনা। এই পৃথিবীকে শূন্যে রাখিবার জন্য বাসুকীর মাথায় তাহাকে বসান হইল, আবার তাহাতেও লোকের মন ওঠে নাই— মানুষ ক্ষীর সমুদ্রে কচ্ছপের কল্পনা করিয়া সেই কচ্ছপের পিঠে হাতি, হাতির পিঠে বাসুকী শুদ্ধ পৃথিবীকে চাপাইয়াছে। গ্রীস দেশের পুরাণে পৃথিবীটাকে পাতলা চাকতির মতো কল্পনা করা হইয়াছে। সেই অদ্ভুত চাকতি টুক্‌রা টুক্‌রা হইয়া সমুদ্রের মধ্যে ছড়ান রহিয়াছে— সে সমুদ্রের আর শেষ নাই, কূল কিনারা কোথাও নাই। কোন কোন দেশে এই জগৎটাকে একটা ঢাকনি-দেওয়া সরার মতো মনে করা হইত। চন্দ্র সূর্য শুদ্ধ আকাশটাকে ঢাকনি আর পৃথবীটা সরা। এই পৃথিবীর চেহারাটা বর্ণনাই কি কম পাওয়া যায়? তিন কোণা, চার কোণা, টাকার মতো, বাটির মতো, পদ্মের মতো কতরকমের কল্পনা!

নরওয়ে দেশের পুরাণে বলে এই পৃথিবীটা একটা দৈত্যের মৃতদেহ। পৃথিবীর স্থলের ভাগ তার মাংস, এই সমুদ্রগুলি তার রক্ত, পাহাড়গুলি তার হাড় আর দাঁত, আর গাছপালা সব তার গায়ের লোম আর চুলের জটা। সৃষ্টির আদিকাল হইতে অন্ধকার আর শীতের দৈত্যগুলার সঙ্গে আগুন ও আলোর দেবতাদের লড়াই লাগিয়া আছে। দৈত্যযোদ্ধা ঈমিরকে বধ করিয়া দেবতারা তার শরীরটাকে আকাশের একটা প্রকাণ্ড ফাঁকের মধ্যে গুঁজিয়া সেইখানে এই পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। মনের মতো পৃথিবী গড়িয়া তাঁহারা দৈত্যের মাথার খুলিটা দিয়া আকাশ বানাইলেন, সেই আকাশে দৈত্যের মগজ ছিটাইয়া মেঘের সৃষ্টি হইল। তখন সকলে বলিলেন, এমন সুন্দর পৃথিবী, ইহাকে অন্ধকার রাখা চলে না, ইহার জন্য আলো চাই। তাঁহারা সমস্ত আকাশটার গায়ে আগুন ছিটাইয়া তারপর বড় বড় দুইটা আগুনের গোলা দিয়া চন্দ্র সূর্য গড়িলেন। সেই চন্দ্র সূর্যের চমৎকার রথ গড়া হইল। সল্‌ (সূর্য) ও মানি (চন্দ্র) দুই মহাবীর হইলেন রথের সারথি।

সমস্তই ঠিক হইল, কেবল দুইটি ভয়ানক দৈত্য নেকড়ে বাধের চেহারা ধরিয়া কখন যে চন্দ্র সূর্যের পিছনে ছুটিতে লাগিল দেবতারা তাহাদের আটকাইতে পারিলেন না। দৈত্য দুইটার নাম স্কোল্‌ (ঘৃণা) ও হাটি (বিদ্বেষ)। তাহারা দেবতাদের এই কীর্তি নষ্ট করিবে বলিয়া সেই হইতে আজ পর্যন্ত পিছন পিছন ছায়ার মতো ছুটিয়া চলিতেছে। কখন এক একবার তাহারা একেবারে চন্দ্র সূর্যের ঘাড়ের উপর পড়িয়া তাহাদের গিলিবার উপক্রম করে; তখন স্বর্গে মর্ত্যে— চারিদিকে ভয়ানক কোলাহল করিয়া লোকে হায় হায় কারিতে থাকে; সেই কোলাহলের ভয়ে দৈত্যেরা মুহূর্তের জন্য জমিয়া যায় আর চন্দ্র সূর্যও সেই ফাঁকে আবার ছুটিয়া বাহির হয়। এইরকমভাবে গ্রহণের পর গ্রহণ আসে আর চন্দ্র সূর্যের প্রাণ লইয়া টানাটানি পড়ে। এমন একদিন আসিবে যখন এই দৈত্য চন্দ্র সূর্যকে একেবারে গিলিয়া হজম করিয়া ফেলিবে। তখন প্রলয় আসিয়া সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করিয়া ফেলিবে।

চন্দ্রের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, তাহাদের নাম হিউক আর বিল্‌। তাহারা আগে পৃথিবীতে থাকিত। সেই সময়ে তাহাদের নিষ্ঠুর বাপ সারারাত তাহাদের দিয়া জল বহাইত। সেইজন্য চন্দ্র তাহাদের পৃথিবী হইতে কাড়িয়া নিয়া নিজের বুকে লুকাইয়া রাখিয়াছেন। ঐ যে চাঁদের গায়ে কালো কালো দাগ দেখিতে পাও সেগুলি আর কিছু নয়, হিউক ও বিল্‌ তাহাদের মায়ের কোলে ঘুমাইয়া আছে। ইংরাজিতে যে ছেলে ভুলানো ছড়া শুনা যায়—

Jack and Jill went up the hill to
feth a pail of water.
(জ্যাক ও জিল্‌ জল আনিতে পাহাড়ে উঠিল)।

সেই ছড়ার জ্যাক ও জিল্‌ বাস্তবিক এই হিউক ও বিল্‌। তাহাদের গল্প নরওয়ে দেশের নাবিকদের মুখে মুখে ইংলন্ড পর্যন্ত আসিয়া এখন এইরকম দাঁড়াইয়াছে।

আমাদের দেশের পুরাণেও এইরূপ গল্প আছে— সমুদ্রমন্থনে অমৃত উঠিল, দৈত্যদিগকে ফাঁকি দিয়া দেবতারা সে অমৃত বাঁটিয়া খাইলেন। রাহু দৈত্য লুকাইয়া দেবতাদের সঙ্গে বসিয়া সে অমৃতের ভাগ লইল। চন্দ্র সূর্য রাহুকে ধরিয়া ফেলিলে বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দিয়া তাহার মাথা কাটিয়া ফেলিলেন। সে অবধি রাহুর কাটা মাথা রাগিয়া এক একবার চন্দ্র সূর্যের ঘাড়ের উপর বসিয়া পড়িয়া তাহাদের গিলিবার আয়োজন করে আর তাহাতেই গ্রহণ হয়।

এই লেখাটি বার পড়া হয়েছে